বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১১

কালবোশেখী হৃদ্যতা


১)

রাত ২টা বেজে আটত্রিশ মিনিট। আজকের দিনটা একটু অন্যরকম, অন্যান্য দিন গুলোর থেকে একটু আলাদা। পহেলা বৈশাখের প্রথম রজনী আজ। ঘন্টা তিনেক আগে বেশ তান্ডবময় ঝড়-তুফান হয়ে গেলো। বোধ হয় কালবোশেখী। পরিবেশটা বেশ থমথমে। এতো নিরিবিলি, এতো চুপচাপ .........বাতাসটা পর্যন্ত নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে। ভেজা রাতের নিস্তব্ধতাটা কেমন যেনো লাগছে।
হা করে আকশের দিকে তাকিয়ে আছে নীলিমাচোখের কোন থেকে গাল বেয়ে পানি নেমে আসছে। সে কান্নায় এতোটুকু শব্দ নেই। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দ করে কান্না করার সাহস নীলিমার নেই।

২)

১৪১৫ এর পয়লা বৈশাখ। নীলিমা আর তার বন্ধু-বান্ধবরা চারুকলাতে আড্ডা দিচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হলো, সবাই দৌড় দিলো! পৃথিবীর সব রঙ যেনো এই শোভা যাত্রায় এসে নিজেকে উজার করে দিয়েছে। হাজার রঙের সম্মেলন, ঢোল-ডুগডুগি আর বাঁশির শব্দ আর তার সাথে শত শত তরুন-তরুনীর সংজ্ঞাহীন উন্মাদনা – এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। নীলিমা যখন তার বান্ধবীদের সাথে নাচছিলো, তখন শাফিন যে তাকে খুব সাবধানে ঘিরে রেখেছিলো যাতে অন্য কারো সাথে ধাক্কা না খায় বা কেউ যাতে তাকে স্পর্শ না করে, সেদিকে নীলিমার খেয়াল ছিলোনা।
শাফিন আর নীলিমা একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করে। শাফিন যে নীলিমার দিকে আড়চোখে তাকায় সেটা নীলিমা টের পেয়েছিলো তবে তা প্রেম পর্যন্ত যাবে কিনা সে অতো ভাবেনি।
সারাটাদিন শাফিন নীলিমার পিছেই লেগে থাকলো। কখনো পানি এনে দেয় তো কখনো চালতার আচার। আবার পাখা এনে দেয় যাতে গরম না লাগে, একটু একটু করে নীলিমা ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে।
সারাটাদিন হাটাহাটির পরে সন্ধ্যার পর রিক্সায় করে বাড়ি ফেরার পথে শাফিন একদম চুপ করে রইলো।
-       কিরে? তোর মন খারাপ?
-       না।
-       কিছু বলবি?
-       হুম, মানে না।
-       বলে ফেল।
-       না কিছু...... ও রকম কিছু না।
-       দেখ, আজকের দিনটা খুব ভালো একটা দিন। জীবনকে নতুন ভাবে সাজানোর দিন। আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি, কিন্তু আমি চাই যা বলার তুই বলবি। আমি কোনোকিছু আঁচ করে বসে থাকতে চাইনা।
-       নীলু।
-       বল।
-       আমি আমার জীবনের বাকি পহেলা বৈশাখ গুলোতে তোর হাত ধরে এই রাস্তায় হাটতে চাই।
-       তোর কথা শেষ?
শাফিন চুপ করে নীচে তাকিয়ে রইলো। নীলিমা রিক্সাওয়ালাকে বললো, “ভাই, একটু থামান তো। আমি নেমে যাবো”

৩)

-       এই, তুমি এতো বিয়ে বিয়ে করো কেনো?
-       করবোনা? প্রেম করেছি কি জন্য? বিয়ে করার জন্য না?
-       এখন বিয়ে করে আমাকে রাখবা কই? খাওয়াবা কি?
-       আমরা গাছতলায় থাকবো! বাতাস খাবো। মানুষ আমাদের থেকে পানি পড়া নিতে আসবে।
-       সারাদিন খালি ফাজলামো করো ! ধ্যাত!
-       পাখি, রাগ করেনা। এই জামাটা ভালো লাগে?
-       তুমি এই জামা পরে নাচো গিয়ে যাও!
-       এই পাখি, এমন করো কেনো? সরি সরি সরি।
-       কানে ধরো
-       ধরলাম।
-       জিব বের করো
-       করলাম।
-       হুম, এই জামাটা সুন্দর।
শাফিন আর নীলিমা পয়লা বৈশাখের জন্য শপিং এ বের হয়েছে। দু বছর হলো তাদের সম্পর্কের। শাফিন ছেলেটা বড্ড বিয়েপাগলা ! সারাটাদিন খালি দিন গুনে যে পয়লা বৈশাখ আসতে কতো দেরি, সে পয়লা বৈশাখেই বিয়ে করবে! লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করাটা মন্দ না! নীলিমা খুব আলগা একটা রাগ দেখায়। সেও যে খুব খুশী এটা বুঝতে দেয়না।

৪)

সারা কমলাপুর স্টেশন জুড়ে “শুভ নববর্ষ ১৪১৮” এর ব্যানার টাঙ্গানো। নীলিমা ঘোলা চোখে হাটতে থাকে। ভেজা শরীরে তার শীত শীত করতে থাকে। রাত ৩টা ২০ এ কুমিল্লা থেকে ট্রেন আসবে। নীলিমা সেদিকে হাটতে থাকে।
নীলিমা আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে কাদছে। তার কানে শাফিনের কথাগুলো যেনো হাতুরি দিয়ে আঘাত করছে। কিভাবে এইসব বললো শাফিন? সে বাজারী মেয়ে? বিছানায় কি সে যেতে চেয়েছিলো? তার মতো সস্তা মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব না, এই কথা শোনার জন্য নীলিমা এই পয়লা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করেছিলো? নীলিমা ভাংগা গলায় চিৎকার করে কাদলো, কিন্তু গুমোট বাধা অন্ধকারে কোনো আওয়াজ শোনা গেলোনা।

দূরে আলো দেখা যাচ্ছেনীলিমা উঠে দাড়ালো। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে রেললাইন ধরে হাটতে লাগলো সে। ট্রেইনের হুইসেল বাজছে। তার মঙ্গলশোভা যাত্রার ভেঁপুর কথা মনে পরলো। মনে পরে গেলো, কিভাবে শক্ত করে শাফিন তার হাত ধরে রেখেছিলো।

নীলিমা চোখ বন্ধ করলো। শেষ বিন্দুটি চোখেই রয়ে গেলো।