বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১১

গনিতের উপসংহার

১)

- আরেকটু ভাত নে
- আম্মা, পেট ভরসে তো! আর খামুনা।
- পইত্যেকটা দিন তুই না খায়া ঘুমায় থাওস। তুই ইস্কুল করস, নেহাপড়া করস। না খাইলে শইলে যুত পাইবি কেম্বে?
- খাইসি আম্মা, তুমি খায়া আমার কাসে আহো। মাতায় খুশকি হইসে, বাইচ্ছা দেও ।
প্রচন্ড খিদে নিয়ে খালি পেটে কাথার নীচে আশ্রয় নেয় সাজু। এটা নতুন কিছু নয়। বাটিতে যেইটুকু ভাত আছে, তা অনেকের খাওয়ার পর হাত ধোয়ার সাথেই চলে যায়। মা কি খাবে তাহলে? খিদে পেট নিয়ে ঘুমুতে অবশ্য তার খারাপ লাগেনা, খিদে পেটে ঘুমালে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখা যায়!

সাজু’র ভালো নাম সাজ্জাদুল আলম। তার বাবা আইদ্যা (আহাদ আলী ) ঢাকাতে ৬-সি নম্বর লোকাল বাসের হেল্পার। মা মানুষের বাসায় ২ বেলা কাজ করে, পেশায় যাকে বলে ছুটা বুয়া। দুটো পেট চালানোর জন্য তাকে রীতিমত ছুটতেই হয় সারাটাদিন।

২)

নিধুপাড়া হাই স্কুলে, অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র সাজু। সাধারণত হত দরীদ্র পরিবারের ছেলেরা যেমন অতি মেধাবী হয়, চমক লাগানো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় , সাজু সেরকম না। ক্লাসে সে বরাবরের মতোই সাধারণ মানের ছাত্র। প্রতি বছরই তাকে বিবেচনায় উত্তীর্ন হিসেবে পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত করা হয়, কেননা প্রতি বছরই সে দুইটি বিষয়ে ফেল করে। শারীরিক শিক্ষা আর সামাজিক বিজ্ঞান। গণিতে সে পায় ৫০ কি ৫৫। শুনে গাধা মনে হলেও, সমস্যাটা এখানেই! স্কুলের স্যারেরা তাকে ডাকে পীঠা সাজূ নামে! সাজু যেই অংকই করুক না কেনো, সে জ্যামিতি দিয়ে সেটা করে ফেলে! সে বীজ গনিত হোক আর পাটিগনিত! আর তাই, ছোটো ছোটো চার লাইনের উৎপাদকের সমস্যা সে সমাধান করে চার পাঁচ পৃষ্ঠায়। বেশীর ভাগ ব্যাপার সেপার যায় স্যারের মাথার উপর দিয়ে, তাই নাম্বার পাওয়াটা তার জন্য তাল গাছ থেকে তাল পাড়ার মতো।

৩)

অল্প কয়টা কাচা চুল, আর পুরা মাথার চুল সাদা লোকটার। বিশাল একখান গোফ, হাসিটা ঢেকে না দিয়ে বরং আরো বেশী দেখায়। কিন্তু তার হাসি এখন আসছেনা। মারাত্মক চিন্তায় আছে সে আর তার সাথে আরো ২ জন। তার সাথে আছে একজন মারাত্মক খাটুনি তপস্বী মানুষ। তারও গোফ আছে, তবে অতটা সুকেশী নয়। বাকি যে একজন, তার মুখের বুলিটা বিদেশী, কিন্তু অন্তরটা লাল সবুজে ভরা। এই ৩টা মানুষ যখন তাদের চুল ছিড়ে ফেলছে দেশের পোলাপানদের দুরবস্থা নিয়ে তখন সাজু তার বার্ষিক পরীক্ষার অংক খাতা কুচি কুচি করে ছিড়ে পুকুরে ফেলে দিচ্ছে।

৪)

- কানে যায়না কি বলছি? অংক আর বিজ্ঞান মিলিয়ে ১২০ পেলে সায়েন্স পাবে, নাইলে কমার্স আর নাইলে আর্টস। যা ফুট! সকাল থেকে ঘ্যান ঘ্যান করতেসে!
- স্যার, খোদার কিড়া লাগে স্যার। মন দিয়া পড়বো স্যার এখন থেইকা। আর জীবনে কোনোদিন বইয়ের বাইরে কিচ্ছু লিখবোনা।
- লিখবানা কেনো? তুমি তো বিরাট পন্ডিত মানুষ! অত্র নিধুপাড়া অঞ্ছলে তোমার মতো জ্ঞ্যানতপস্বীর বড়ই অভাব! তুমি চার লাইনে পীথাগোরাসের উপপাদ্য লিখবা আর অন্যেরা ৪ পৃষ্ঠা লাগিয়ে ৩বার চিত্র আকিবে, সমান নম্বর পাইতে চাও? কি শখ! যেনো দুলাভাইএর বাড়ির আবদার! বাইর হও!
- স্যার, পায়ে পরি স্যার। বিজ্ঞানে ৭২ পাইসি স্যার, অংকে আর ২টা নাম্বার দিলে স্যার সায়েন্স পড়তে পারমু স্যার। আম্মার বড় শখ, আমি বিজ্ঞানি হমু স্যার। স্যার দয়া করেন স্যার!
- এ? কি কইলি? বিজ্ঞানী? ওই কে কই আছিস রে! আমারে ধর! হাসতে হাসতে নাড়িভুড়ি গিট্টু লাইগা গেছে! হা হা হা। বিজ্ঞানী !! হা হা হা............... তো বাবা, আপনি কি আবিষ্কার করিবেন? নিউটন হইবা? আইনিশটাইন হইবা?

স্যার খুব বাজে ভাবে হাসতে লাগলো। দীর্ঘদিনের না মাজা অপরিষ্কার দাঁতের গন্ধে তার বমি আসতে লাগলো। সে শেষবারের মতো বললো-
- স্যার, আপনি যা চান, আমি তাই করবো। শুধু সায়েন্সে পড়ার একটা সুযোগ দেন।
- ( গলা নামিয়ে) এই মাসের মইধ্যে আমারে ১৫টা টিউশনি আইনা দিবি। যদি পারিস তাইলে তোরে সায়েন্স দিবাম পারি!
সাজু নিরুপায় হয়ে রাজী হয়ে গেলো।

৫)

বাড়িতে ফিরে সাজু তার বাবাকে দেখতে পেলো। বাবাকে সে যমের মতো ভয় পায়। বাবা তাকে এখনো দেখেনি। সে খুব মনযোগের সাথে তার গোফ-দাড়িতে চিরুনী চালাচ্ছে। আম্মা তাকে দেখে ডাক দিলো।
- সাজু, তোর বাপে আইসে, কাসে আয়!
- জে মা, আসি।
সাজু তার বাবা’র পাশে এসে বসলো। তার বাবা তাকে দেখে একটা হাসি দিলেন, হাসির ঝলকে সাজুর মুখ শুকিয়ে শুকনা কিসমিসের মতো হয়ে গেলো।
রাতে শোবার আগে সাজুর বাবা সাজুকে ডাক দিলো।
- তোর পড়াশুনার কি অবস্থা?
- জি ভালা
- ভালা মানে কি? নতুন কেলাসে উঠসোস?
- জি উঠসি। নতুন বইও পাইসি।
- ছাইঞ্ছ নাকি কমাশ?
- সাইন্স আব্বা।
- ডাকটর হইতে না পারলে পিঠের ছাল তুইলা ফালামু হারামজাদা! হারাদিন মালিবাগ,বাংলামটর,ফারমগেট,আগারগাও কইতে কইতে মুখে ফেনা জমায়া হেই টেকা দিয়া তোরে পড়াই। তোর মায় মাইনষের বাসায় কামলা খাইটা তোরে খাওয়ায়। তাও যদি শুনি, নেহাপড়া করস না, কীড়া কাইট্টা কইলাম, এক্কারে জবাই দিমু! যা, অহন ঘুমাইতে যা! আমি কাইলকা সকালে যামুগা। নতুন কেলাসে ভর্তির টেকা দিয়া গেসি, তোর মা’র থেইক্কা লয়া লবি।
- জি আচ্ছা।
ভয়ে সাজুর আত্মা পানি হয়ে গেছে! তার বাবা যখনই তাকে বকে, তখনি তার প্রচন্ড পিশাব ধরে। এখনো তাই। সে এক দৌড়ে ঝোপে গেলো।

৬)

- আমার মনে অয় যে সবার আগে সবচেয়ে বড় বড় গুন , ভাগ করতে পারবো, হেগো লইয়া দৌড়াদৌড়ি করবো।
- আমার মনে অয় মশাল হাতে লইয়া সুত্র মুখস্ত কইতে অইবো আর দৌড়ান লাগবো।
বাজারে পোস্টার দেখে সবার মনে একটাই প্রশ্ন, “ গনিত অলিম্পিয়াড” আবার কি জিনিস? পোস্টারটাও আজব!

π কি করে পাই?
শুন্য জোড় নাকি বেজোড়?
আরো হাবিজাবি বেশ কিছু লিখা ছিলো, কয়েকটা কার্টুনও ছিলো। সাজু পোস্টার দেখে শুধু এতোটুকুই বুঝলো, শুক্রবারদিন ইশকুলের মাঠে সকালে থাকা লাগবে।

৭)

এই ২-৩দিনের মধ্যে মোটামুটি সবাই জেনে গেছে যে শুক্রবারদিন একটা অংক পরীক্ষা হবে। যারা পাশ করবে তাদের সোনার মেডেল দিবে আর ঢাকায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। ঢাকায় যাবে, এফডিসিতে শাকিব খান , অপু বিশ্বাসকে দেখতে পারবে, এই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে শ’খানেক পোলাপান শুক্রবার ইশকুল মাঠে হাজির হলো। বেলুন উড়ানো, ঘন্টাখানেক লাইনে দাড় করায় রাখার কারণে বেশ কিছু পোলাপান চলে গেছে।

একটু পরেই সাদা ঝাকরা চুলওয়ালা এক লোক, তার সাথে হাশিখুশী একজন ভদ্রমহিলা আর একজন মোটাসোটা গোফওয়ালা লোক, পতাকা উড়িয়ে হাততালি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। এরপর লাইন করে সবাই ক্লাসে যেতে লাগলো।

সাজু’র কাছে অংকের আলাদা কোনো বই নেই। তাই গতকাল রাত পর্যন্ত শুধু বোর্ড বইয়ের অনুশীলনী ছাড়াও যে পৃষ্ঠা গুলো ছিলো, সেগুলা বুঝে বুঝে দেখে এসেছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা!

৮)
দেড় ঘন্টা পর কেক, জুস আর সার্টিফিকেট হাতে পোলাপান বের হয়ে আসলো। মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। এইগুলা কি? অংক পরীক্ষা দিতে এসেছে অথচ বই থেকে কোনো অংকই দেয় নাই! ফাইজলামী নাকি! ধরে বাড়ির সামনের কালা পুকুরে চুবানো উচিত!

সাজু ৪টা অংক করতে পেরেছে। বাকিগুলা সে ধরারই সুযোগ পাইনি। এত্তো কঠিন অংক বানায় কারা? ভেবে কোনো কুল-কিনারা পায় না সাজু।

৯)

প্রশ্ন শুনে সাদা চুল ওয়ালা লোকটার মুখের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো, কেমন হা করে তাকিয়ে রইল সে সাজুর দিকে!
- কোন ক্লাসে পড় তুমি?
- নাইনে।
তিনি তার পাশের লম্বা , সাদা দাড়িওয়ালা লোকটার সাথে চুপেচাপে আলাপ করতে লাগলো। প্রশ্নটা কঠিন কিছু না, কিন্তু ঢাকা থেকে ৩৫০ মাইল দূরে, বিদ্যুৎ যেই গ্রামে এখনো পৌছায়নি, সেই গ্রামের মাত্র নাইনে পড়ুয়া একটি ছেলের মুখে কোয়ান্টাম ইঙ্গেলমেন্ট এর প্রশ্ন শুনে সবাই ভেবাচেকা খেয়ে গেলো! তবে, সাজু নিজেও জানেনা তার প্রশ্নটা যে কোয়ান্টাম ইঙ্গেলমেন্ট নিয়ে। প্রশ্নটা ছিলো অনেকটা এরকম-
“ আমরা বইয়ে পড়সি যে, পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণিকার গুলার ১টা হলো ইলেক্ট্রন। এগুলা নাকি জোড়ায় জোড়ায় থাকে। আবার এরা উলটা হয়ে ঘুরতে থাকে। একটা ডানদিকে ঘুরলে আরেকটা বাম দিকে ঘুরে। যদি আমি একটাকে ধইরা উলটা দিকে ঘুরায় দেই, তাইলে কি হইবে? “

সাজুকে ২-৩জন প্রশ্নের উত্তরটা বোঝানোর বেশ চেষ্টা করলো, কিন্তু সে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে বুঝতে পারলোনা। শেষে বাধ্য হয়ে সে হাসিমুখে বললো, “ স্যার, আমি বুজছি!” তাকে ডেকে একটা বই দেয়া হলো, ছবিও তুললো উনাদের সাথে।


১০)

লজ্জায় সে কাদতে পারছেনা, কিন্তু ব্যাথায় তার বুক ফেটে কান্না আসছে। বাবা তাকে হাত-পা ছাড়াও শরীরের এমন সব জায়গায় মেরেছে যা বলার মতোনা। পড়াশুনা বাদ দিয়ে অংক নিয়ে দৌড়ানোর উৎসবে গিয়েছে শুনে তাকে বড়ইগাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলেছে। ৩টা অংক করে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তাকে মেডেল আর সার্টিফিকেট দিয়ে ঢাকায় ক্যাম্প করার জন্য দাওয়াত দিয়েছে- এই কথা শুনে তার বাবা ভাত খাওয়া থেকে উঠিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে। তার মা হাত পা ডলে দিচ্ছে আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে।
- আমারে কইয়া গেলিনা ক্যা? জানস না তোর বাফে কেমন? আমারে কইয়া গেলে তো তোরে যাইবার দিতাম না।
- আমি কি একা গেসি আম্মা? আর অংক করন কি খারাফ?
- বইয়ের অংক না কইরা তুই গেসস খেলার অংক করতে। এই অংক কি তোরে ভাত দিব?
এরপর আর কি বলার আছে? প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েই সে ঘুমাতে লাগলো। স্বপ্ন দেখতে লাগলো। দেখলো, “ওই ঝাকরা সাদা চুলের লোকটা আর মোটাসোটা গোফওয়ালা লোকটার হাত ধরে সে শিশুপার্কে যাচ্ছে। শিশু পার্কে বিশাল বড় বড় সব ত্রিভুজ! বিভিন্ন রঙের ত্রিভুজ! কোনোটা লম্বা, কোনোটা বেটে, কোনোটা আবার হাসে, কথা বলে! একটা লোক আসলো, তার মাথাটা একটা সমবাহু ত্রিভুজের মতো, এসে তাকে সোনার মেডেল পড়িয়ে দিলো। আকাশটাও কেমন তিন কোনা। দুনিয়া তার কাছে তিন কোনা লাগতে লাগলো।“

১১)



দোকানের শাটার নামিয়ে সাজু হাটতে লাগলো। বাম হাতে গজ দশেক তার, পকেটে প্লাস, পেরেক আর ডান হাতে ড্রিল মেশিন নিয়ে সাজু কাস্টমারের বাসায় যাচ্ছে। যাওয়ার সময় দেখলো, কারওয়ান বাজারে একটা বিল্ডিং এর নীচে বিশাল লাইন। এরা সবাই গনিত অলিম্পিয়াডের জন্য নাম লিখাতে এসেছে। খুব গোপনে সে চোখের পানি মুছে নিলো যাতে কেউ না দেখে। আট বছর আগের সেই গোলাকার মেডেলটা এখনো তাকে অনেক কাঁদায়।